১৬ মে, ২০২৫ তারিখে রংপুরের ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে “মৌলিক মানবাধিকার ও যুবসমাজের ভূমিকা” শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মশালাটি হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এবং ইউএন রেসিডেন্ট কো-অর্ডিনেটর’স অফিস (ইউএনআরসিও)-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল যুবসমাজকে মানবাধিকারের মৌলিক ধারণা, লঙ্ঘন এবং সুরক্ষার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে শিক্ষিত করা।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মানবাধিকারের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং যুবসমাজকে তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা হয়। দিনব্যাপী এই কর্মসূচিতে বিভিন্ন সেশনে মানবাধিকারের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
কর্মশালার শুরুতেই সকাল ৭:৪৫ থেকে ৮:৩০ পর্যন্ত অংশগ্রহণকারীরা ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে এসে নিবন্ধন করেন এবং প্রাতঃরাশ গ্রহণ করেন। এরপর, সকাল ৮:৩০ থেকে ৮:৪৫ পর্যন্ত এইচআরএসএস-এর নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম একটি “আইস ব্রেকিং” সেশন পরিচালনা করেন এবং অংশগ্রহণকারীদের স্বাগত জানান। এই সেশনের মাধ্যমে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করা হয়, যা পরবর্তী আলোচনাগুলোর জন্য সহায়ক ছিল।
সেশন ১: মানবাধিকারের ধারণাগত ধারণা
যেখানে মানবাধিকারের মৌলিক ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এই সেশনটিও পরিচালনা করেন এইচআরএসএস-এর নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম। তিনি মানবাধিকারের সংজ্ঞা, এর প্রকারভেদ, এবং গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। তিনি সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (ইউডিএইচআর) এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ (আইসিসিপিআর)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক দলিলগুলোর ওপর আলোকপাত করেন। তিনি আলোচনা করেন, এই অধিকারগুলো কেন প্রতিটি মানুষের জন্য অপরিহার্য এবং এই দলিলগুলো কীভাবে বাংলাদেশ ও তার নাগরিকদের সাথে সম্পর্কিত। সেশনের শেষে অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়া হয়, যা তাদের মানবাধিকার সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে সাহায্য করে।
ইজাজুল ইসলাম তার বক্তব্যে মানবাধিকারের সার্বজনীনতা এবং প্রতিটি মানুষের জন্য এর অপরিহার্যতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “মানবাধিকার কোনো বিলাসিতা নয়, বরং মানুষের মর্যাদা ও সমতার সাথে বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত। যুবসমাজকে মানবাধিকারের এই মৌলিক ধারণা সম্পর্কে সচেতন করা এবং অধিকার রক্ষায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আমাদের প্রধান লক্ষ্য।” তিনি আরও বলেন, “ইউডিএইচআর এবং আইসিসিপিআর-এর মতো দলিলগুলো আমাদের অধিকারের সুরক্ষা ও প্রচারে একটি শক্তিশালী কাঠামো প্রদান করে। আমাদের এই দলিলগুলো সম্পর্কে জানতে হবে এবং এর নীতিগুলো বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।”
সেশন ২: মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত ও ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিংয়ের পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া
সকাল এই সেশনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত এবং ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিংয়ের পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি প্রার্থী মুহাম্মাদ আব্দুর রাকিব। তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা চিহ্নিতকরণ, ভুক্তভোগীর প্রোফাইল তৈরি, অপরাধীর পরিচয় ও উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করার গুরুত্ব তুলে ধরেন। এছাড়াও, তিনি তদন্ত প্রক্রিয়ায় আইনি কাঠামো, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড এবং ডকুমেন্টেশন ও প্রমাণের ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি একটি কার্যকর ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্ট তৈরির কৌশল এবং এর মাধ্যমে মানবাধিকার সুরক্ষায় অবদান রাখার উপায় সম্পর্কেও ধারণা দেন।
মুহাম্মাদ আব্দুর রাকিব তার বক্তব্যে বলেন, “মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্ত প্রক্রিয়ায় বস্তুনিষ্ঠতা, স্বচ্ছতা এবং ভুক্তভোগীর প্রতি সংবেদনশীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। একটি শক্তিশালী ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্ট তৈরি করতে পারলে, আমরা কেবল সত্য উদঘাটন করতে পারি না, বরং অপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করতেও পারি।”
তৃতীয় সেশনে মানবাধিকার সহিংসতার ডকুমেন্টেশন ও নিউজ ক্লিপিং নিয়ে আলোচনা করা হয়। এই সেশনটি পরিচালনা করেন এইচআরএসএস-এর নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম। তিনি মানবাধিকার ডকুমেন্টেশনের মৌলিক নীতি, ডকুমেন্টেশন ও রিপোর্টিংয়ের প্রক্রিয়া এবং মানবাধিকার সহিংসতার ডেটা বিশ্লেষণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর যথাযথ রেকর্ড রাখা এবং তা গণমাধ্যমে তুলে ধরার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন।
ইজাজুল ইসলাম বলেন, “মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর ডকুমেন্টেশন করা এবং তা নিউজ ক্লিপিংয়ের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এর মাধ্যমে আমরা ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ তৈরি করতে পারি, যা ভবিষ্যতে আইনি প্রক্রিয়ায় কাজে লাগে। এছাড়াও, গণমাধ্যমে এই ঘটনাগুলো তুলে ধরলে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং অপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা সহজ হয়।”
সেশন ৪: সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (ইউডিএইচআর) এবং বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকার সুরক্ষা
চতুর্থ সেশনে এইচআরএসএস-এর গবেষণা কর্মকর্তা আবু সাদাত মো. সায়েম সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (ইউডিএইচআর) এবং বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকার সুরক্ষার বিধানাবলী নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বাংলাদেশে মানবাধিকারের প্রেক্ষাপট, রাষ্ট্র কর্তৃক নিশ্চিত করা অধিকার এবং মানবাধিকার সম্পর্কিত সাংবিধানিক বিধান ও অধিকার প্রয়োগের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন। তিনি সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ এবং মৌলিক অধিকারগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন, যা নাগরিকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আবু সাদাত মো. সায়েম তার বক্তব্যে বলেন, “বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের সংবিধান মানবাধিকারের একটি শক্তিশালী ভিত্তি। তবে, শুধু অধিকার জানলেই হবে না, প্রয়োজনে সেই অধিকার আদায় করতেও আমাদের সক্ষম হতে হবে।”
বিকেলে ইউডিএইচআর এবং মৌলিক অধিকারের উপর একটি দলগত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এই কার্যক্রমটি পরিচালনা করে এইচআরএসএস-এর একটি দল। এই দলগত কাজে অংশগ্রহণকারীরা মানবাধিকারের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করার এবং নিজেদের মধ্যে ধারণা বিনিময়ের সুযোগ পান।
সেশন ৫: মানবাধিকার রক্ষাকারীদের ভূমিকা ও দায়িত্ব এবং নেটওয়ার্ক গঠন
পঞ্চম ও সমাপনী সেশনে এইচআরএসএস-এর নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম মানবাধিকার রক্ষাকারীদের ভূমিকা, দায়িত্ব এবং একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গঠনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি কেন মানবাধিকার রক্ষা করা প্রয়োজন এবং মাঠ পর্যায়ে মানবাধিকার কর্মীদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেন। তিনি যুবসমাজকে মানবাধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এবং তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার উপর জোর দেন।
ইজাজুল ইসলাম বলেন, “মানবাধিকার রক্ষা করা শুধু সরকার বা কিছু সংস্থার দায়িত্ব নয়, এটা আমাদের সকলের দায়িত্ব। যুবসমাজকে মানবাধিকার রক্ষায় সক্রিয়ভাবে জড়িত করতে পারলে, আমরা সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারব। একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারলে, আমরা আরও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আরও জোরালোভাবে প্রতিবাদ করতে পারব।”
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) উদ্যোগে আয়োজিত দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সমাপ্তিতে রংপুর বিভাগে নতুন নেতৃত্ব ঘোষণা করা হয়। শুক্রবার (১৬ মে, ২০২৫), রংপুরের দর্শনায় অবস্থিত ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে “মৌলিক মানবাধিকার ও যুবসমাজের ভূমিকা” শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালা শেষে মোঃ সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিককে হিউম্যান রাইটস সোসাইটি রংপুর ডিভিশনের বিভাগীয় সমন্বয়ক এবং আবুল খায়ের জাইদকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক হিসেবে মনোনীত করেন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক এজাজুল ইসলাম।
কর্মশালার শেষ পর্যায়ে, বিকেল ৫:১৫ থেকে ৫:৩০ পর্যন্ত এইচআরএসএস-এর নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলামের সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে কর্মশালার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
এই প্রশিক্ষণ কর্মশালাটি মানবাধিকার সম্পর্কে যুবসমাজের জ্ঞান বৃদ্ধি, তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি এবং সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা মানবাধিকারের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন এবং ভবিষ্যতে এই ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অনুপ্রেরণা লাভ করেন।